চাঁদা না দেওয়ায় রাজবাড়ীতে হাসপাতালের লিফট স্থাপনের কাজ বন্ধ

রাজবাড়ী (জেলা) প্রতিনিধি
রাজবাড়ী (জেলা) প্রতিনিধি
২১ জুলাই, ২০২৫ এ ৩:০৪ এএম
রাজবাড়ী হাসপাতাল। : ছবি সংগৃহীত

রাজবাড়ী হাসপাতাল। : ছবি সংগৃহীত

রাজবাড়ীর সদর হাসপাতালে উন্নয়ন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে এক চাঁদাবাজ চক্রের কারণে। সরকারি অর্থায়নে নির্মাণাধীন ২৫০ শয্যার হাসপাতালের লিফট স্থাপনের কাজ বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। স্থানীয় একটি চক্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার চাঁদা দাবি করে আসছে। চাঁদা না দিলে তারা হুমকি দিচ্ছে, এমনকি অস্ত্র দেখিয়ে প্রকল্প এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে।

সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিষয়টি উঠে আসে। সভায় রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, লিফট স্থাপন কাজের ঠিকাদার ও তার সহকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাদের কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং মাঝে মাঝেই মালামাল লুটের চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতিকারী ব্যক্তি হাসপাতালের লিফটের কাজের সাইটে এসে বারবার চাঁদা দাবি করছে। এক গ্রুপ চাঁদা নিয়ে চলে যাওয়ার পর আবার অন্য গ্রুপ এসে হাজির হয়। ঠিকাদার পক্ষ হতাশ ও আতঙ্কে ভুগছে। এর আগে হাসপাতালের এসির তার, আউটডোর সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে গেছে। নিরাপত্তার অভাবে কাজের অগ্রগতি থমকে গেছে।”

উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারি দুপুরে ৮ থেকে ১০ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী লিফট স্থাপনার সময় প্রকল্প সাইটে ঢুকে পড়ে। তারা প্রকাশ্যে চাঁদা দাবি করে এবং চাঁদা না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। তারা প্রকল্পে থাকা মূল্যবান মালামাল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ঠিকাদার কর্মীদের সাহসিকতায় তারা ব্যর্থ হয়।

এই ঘটনার পরদিন, ২০ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজবাড়ী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। সেই চিঠির অনুলিপি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দপ্তরে পাঠানো হয়। চিঠিতে পরবর্তী দুই মাসের জন্য নিরাপত্তা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়।

এরপর ২১ জানুয়ারি গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশিদ মন্ডল রাজবাড়ী সদর থানার ওসির কাছে আরও একটি চিঠি দেন। চিঠিতে মালামাল ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হয়। চিঠির কপি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়।

পুলিশ প্রশাসনের অবস্থান:

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, “হাসপাতালের লিফট নির্মাণ প্রকল্পে চাঁদাবাজির অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছি। রাজবাড়ীতে চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। দোষীদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।”

নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া:

রাজবাড়ী নাগরিক কমিটির সভাপতি জ্যোতি শঙ্কর ঝন্টু বলেন, “হাসপাতাল দেশের সবচেয়ে মানবিক অবকাঠামো। সেখানে নির্মাণ কাজের জন্য চাঁদা দাবি করা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই ধরনের সন্ত্রাসীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারিভাবে প্রকল্পে কাজ চলাকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত ছিল। চাঁদাবাজদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে প্রকল্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।”

উন্নয়ন প্রকল্পের প্রেক্ষাপট:

২০১৮ সালে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে রোগীদের বাড়তি চাপ এবং চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় হাসপাতালের বিভিন্ন নতুন ভবন, অত্যাধুনিক সরঞ্জাম, এসি, জেনারেটর এবং লিফট স্থাপন করার কথা ছিল।

বর্তমানে ৩ কোটি ৯১ লাখ ৮১ হাজার টাকা ব্যয়ে ৮ তলা পর্যন্ত লিফট স্থাপনের কাজ চলমান ছিল। কিন্তু স্থানীয় চাঁদাবাজ চক্রের বাধার কারণে কাজ এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। এতে সাধারণ জনগণ ও রোগীদের মধ্যে চরম হতাশা এবং উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

শেষ কথা:

সরকারি অর্থায়নে নির্মাণাধীন হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাজে চাঁদাবাজি জাতীয় অপরাধের শামিল। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে লিফট স্থাপনে এই ধরনের বাধা না কেবল একটি প্রকল্প থামিয়ে দিচ্ছে, বরং মানুষের জীবন-সেবার পথেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এ বিষয়ে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পও ঝুঁকির মুখে পড়বে।


আজকের প্রথা/মেহেদি-হাসান