নুরুন নাহারের কষ্টের সংগ্রাম

পিরোজপুরের নারীর কফি বিক্রেতা হয়ে উঠার গল্প

মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ এ ৭:০৫ এএম
টাঙ্গাইলের মধুপুরে ভ্রাম্যমাণ কফি বিক্রি করছেন প্রতারণার শিকার নুরুন নাহার। ছবি : আজকের প্রথা

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ভ্রাম্যমাণ কফি বিক্রি করছেন প্রতারণার শিকার নুরুন নাহার। ছবি : আজকের প্রথা

টাঙ্গালের মধুপুর পৌর শহরের বজারে, রাস্তায়, ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ কফির দোকান চালান নুরুন নাহার। বেশ জনপ্রিয় তার কফি। দেখে মনেই হতে পারে সংসার চালানোর জন্য হয়ত তার এ সংগ্রাম। কিন্তু পিছনের গল্পটা সে রকম নয়। খুবই হৃদয় বিদারক। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার আমড়াগাছিয়া গ্রামের নুরুনাহারের গল্প এটি। গ্র্যাজুয়েট সুন্দরী নারী নুরুন্নাহার কি অবস্থায় পড়ে এমন কাজে যুক্ত জানা গেছে তার বর্ণনায়।

তিনি জানান, সুইজারর‌্যান্ডে যাওয়ার প্ররোচনায় পড়ে নিজেও খুঁইয়েছেন ৮ লাখ টাকা। সে টাকা ফেরতের কোন লক্ষণ নাই। তারপরও প্রতিদিনের কফি বিক্রির টাকা জমিয়ে মাসে তার শোধ দিতে হয় প্রতারক চক্রের অযাচিত আরও ২০ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেনের দায়। অন্য একজনকে ফিনল্যান্ড পাঠানোর শর্তে লেনদেনের অর্থের সাথে তার সম্পর্ক না থাকলেও দায়টা বর্তিয়েছেতার উপরই।

তার ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে এ টাকা লেনদেন হয় বলেই এ দায় তার।একটি লিগ্যাল নোটিশের ভয় তাকে তাড়া করছে। শত কষ্টেও তাই বিরাট অংকের ওই টাকার শোধ দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গত কয়েক মাসে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার পরিশোধ করতে পেরেছেন। কিন্তু এ যেন সমুদ্রের পানি শামুক দিয়ে সেচার চেষ্টা।

পেছনের কথা জানাতে গিয়ে তিনি জানান, ২০২৩ সালের দিকে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। এখানে কাজ করার সময় এক আত্নীয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় একটি ভুয়া কোম্পানির পরিচালক শামীম আবেদীন নামের একজনের সাথে। চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার শামীম আবেদীন তাকে সুইজারল্যান্ডে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে নিজের প্রতারণার জালে আটকায়।

বিশ্বাসের ভিত মজবুত করতে নুরুন্নাহারের সাথে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ লেদদেন শুরু করে ওই শামীম আবেদীন। ইউরোপীয় দেশসহ পৃথিবীর উন্নত দেশে পাঠানোর সুযোগের কথা বলে তার মাধ্যমে আরও লোকজনকে তার এ জালে ছড়ায়। নুরুনাহারকে জানায়, তার প্রত্যাশিত দেশে পাঠাতে হলে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো সম্ভব নয় । তাই প্রথমে ভারতে যেতে হবে। সেখান থেকে ফ্লাইট হবে। পাসপোর্ট করানো হয়।

সমস্ত আয়োজন করে ভারতে গিয়েও নুরুন্নাহার যেতে পারেননি প্রত্যাশিত সুইজারল্যান্ডে। শামীমের নানা অজুহাতে দেশে ফিরে আসেন ব্যর্থ হয়ে।  আস্তে আস্তে শামীমকে সন্দেহ হতে থাকে। কিন্তু যা হবার তা ইতোমধ্যে ঘটে যায়।তাকে দেয়া ভিসা ভুয়া ধরা পড়ে। নিজের আত্নীয় ছাড়াও নুরুন্নাহারের মাধ্যমে বিদেশ যেতে আগ্রহী অনেকেই শামীমের জালে আটকা পড়ে বড় অংকের টাকা দিয়ে বসেন। নুরুন্নাহারের ব্যাংক একাউন্ট ব্যবহার করে এ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তিন পাসপোর্টধারী শামীম আবেদীন।

তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি বিভিন্ন দেশে অবস্থান করার কথা জনায়। দেই দিচ্ছি করে  টাকা ফেরত না দিয়ে নাটকীয় কায়তায় ৫/১০ হাজার করে আবারও বিকাশে হোন্ডিতে টাকা নেয়। বলে- টাকা পাঠাচ্ছি। কিন্তু টাকা আর পাঠায় না সে।

এদিকে নুরুন নাহারের ব্যাংক একাউন্টে টাকা প্রদানকারীরা চাপ দিতে থাকেন। শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার প্রবাসী একজন উন্নত দেশে যাওয়ার আশায় তার এক আত্নীয়ের মাধ্যমে নুরুন্নহারের একাউন্টে টাকা দিয়ে ছিলেন। প্রতারিত হয়ে তিনি তার ওই আত্নীয়ের মাধ্যমে নুরুন্নাহারকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর দপ্তর থেকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে।গত বছরের ১২ ডিসেম্বরে পাঠানো নোটিশ বর্তমানে স্বামী নিয়ে বসবাসকারী টাঙ্গাইলের মধুপুরের ভাড়া বাসায় আসে। নোটিশ পেয়ে নুরুন্নাহার চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন। উপায় না দেখে ঘরে বিষ রেখে আত্নহত্যার চিন্তা করছিলেন। এক পর্যায়ে অনলাইনের একটি সাইটে কফি বিক্রির আইডিয়া পান।

চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট একজনের  সহযোগিতায় ওখান থেকে অনলাইনে একটি কফি তৈরির মেশিন এনে এ ব্যবসায় নেমেছেন। শরীর সাপের্ট  না করলেও অসুস্থ্য শরীরে দুই বেলা তিন বেলা শহরের বাজারে বাজারে কফি বিক্রি করে মাসে যে আয় হয় তা থেকে কোন রকম সংসার চালান। বাকি টাকা জমিয়ে অযাচিত ওই ঋণের শোধ দিতে হচ্ছে।

নুরুন্নাহার জানান, গেল কয়েক মাসে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিতে পেরেছেন। তার শঙ্কা, এভাবে শোধ দিতে তার জীবনে কুলোবে না। তিনি আরও জানান, কুমিল্লার আল আমিন নামের একজন শামীমের খপ্পরে পড়ে দুই কোটি টাকার উপরে খুইয়েছেন। এছাড়া আরো কয়েক জায়গার প্রতারিতরা তার সাথে যোগাযোগ করছেন। শামীমকে ধরার চেষ্টা করছেন।

এই শামীম বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ৭ জন উপদেষ্টার পরিচিত বলে প্রচার করে প্রভাব দেখাাচ্ছে। টাকার কথা বললে হুমকি দিচ্ছে। তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। এ ব্যাপারে নুরুন্নহারসহ প্রতারিতরা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। এদিকে নুরুন্নাহারের কাছে পাওয়া শামীমের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।