শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্থান ও পতনের ইতিহাস

রাজনীতি ডেস্ক
রাজনীতি ডেস্ক
১৮ নভেম্বর, ২০২৫ এ ৬:০৫ এএম
শেখ হাসিনা। ছবি  সংগৃহীত

শেখ হাসিনা। ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে শেখ হাসিনা এক অসামান্য চরিত্র। যে নেত্রী ভারতে অবস্থানকালেই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন, তিনিই আজ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে রাজনৈতিক জীবনের নাটকীয় পতন প্রত্যক্ষ করছেন। বিশ্ব ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই নারীর রাজনৈতিক যাত্রা উত্থান-পতনের এক জীবন্ত দলিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবল প্রতাপে নিজের উপস্থিতি বজায় রেখেছেন শেখ হাসিনা। কখনো তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি, কখনো বিরোধী দলীয় নেত্রী, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার নাম ছাড়া কোনো আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সমালোচনাকারীদের দৃষ্টিতে, ৭৬ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকার পরিণতি আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তার সর্বশেষ শাসনামলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দলটিকে সংকটের গভীরে নিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তুলেছেন বিরোধী মহল।

১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এই সংকটময় সময়ে আওয়ামী লীগ চরম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের সময় পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের আওতায় নতুন করে নিবন্ধন নিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে দলটি।

নেতৃত্ব সংকটে দলের মধ্যে ভাঙনের লক্ষণ দেখা দিলে আব্দুর রাজ্জাক, ড. কামাল হোসেন এবং বেগম জোহরা তাজউদ্দিনের মতো নেতাদের উদ্যোগে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে দলের হাল ধরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, যদিও এই ঘোষণার সময় তিনি ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। দলীয় নেতা নির্বাচিত হওয়ার দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।

মহিউদ্দিন আহমদের বিশ্লেষণে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে দলের মধ্যে শেখ হাসিনার একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেই আবেগকে কাজে লাগিয়েই তাকে সভাপতি করা হয়। তার মধ্যে স্বাভাবিক নেতৃত্বগুণ বিদ্যমান ছিল, যার ফলে দলের ওপর তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন তিনি। এরশাদ সরকারের আমলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা এবং সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে পারার ক্ষমতা তাকে দলের বাইরেও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়।

১৯৯১ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও নির্বাচনে ৮৪টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে যান শেখ হাসিনা, হয়ে ওঠেন দেশের প্রথম বিরোধী দলীয় নারী নেত্রী। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ। একই বছর জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৩৩টি আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি।

তার সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে ২০০১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংঘাতহীনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলার শিকার হন শেখ হাসিনা, যে হামলায় ২৪ জন নিহত এবং অনেকে আহত হন।

এই ঘটনার দুই বছর পর বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ নিয়ে অনড় অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। এর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। এই সময়ে আলোচনায় আসে মাইনাস টু ফর্মুলা। চাঁদাবাজির এক মামলায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রথম এবং একমাত্রবারের মতো গ্রেফতার হয়ে জেলে যান শেখ হাসিনা।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তবে তার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরই ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড বিডিআর বিদ্রোহ, যাতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এই ঘটনায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু করে, যেখানে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষ নেতারা অভিযুক্ত হন। ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে ঢাকা অবরোধ করে হেফাজতে ইসলাম। যৌথ বাহিনীর বলপ্রয়োগে এলাকা খালি করা হয়, এবং দুইদিনব্যাপী সহিংসতায় সরকারি হিসাবে ২৮ জন নিহত হন, যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সংখ্যা আরো বেশি বলে দাবি করে।

২০১৮ সালে ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক ও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দমন করা হয়। মহিউদ্দিন আহমদের মতে, এই সবগুলো আন্দোলনই শেখ হাসিনা তার দলীয় সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দমন করেছেন। বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে, ২০২৪ সালে দ্বিতীয় দফায় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দমনেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার।

আন্দোলন দমনে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৮৪৪ জন হলেও, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে পহেলা জুলাই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারানোর তথ্য উঠে আসে। সহিংসতার মধ্যে কোটাসংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। মহিউদ্দিন আহমদের দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনা দলের সদস্যদের সংকটে ফেলে দিয়ে গুটিকয়েক সঙ্গী ও আত্মীয়দের নিয়ে নিরাপদ অবস্থান নেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচকদের প্রধান অভিযোগ হলো, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। মহিউদ্দিন আহমদের বিশ্লেষণে, শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার ইচ্ছা ছিল, এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে নির্বাচনের পূর্বরাতে ব্যালট পেপারে সিল মারা এবং ২০২৪ সালে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচন করার অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উঠেছে। এছাড়াও বিচারবহির্ভূত গুম-খুন, বিরোধী মত ও রাজনৈতিক দলের ওপর দমনপীড়নের নানা অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে।

এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ জমা হওয়া সত্ত্বেও পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য তিনি প্রশংসাও পেয়েছেন। যদিও এসব প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তার সরকারের বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এবং সর্বশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তির পর তার রাজনীতিতে ফেরার কোনো সুযোগ আছে কি না, এই প্রশ্নটি এখন আলোচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এর উত্তর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা ব্যক্তিবর্গের কার্যক্রমের ওপর। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্যে, যদি তারা শেখ হাসিনার চেয়ে খারাপ কাজ করেন বা তার মতোই কাজ চালিয়ে যান, তাহলে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফেরার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।