কোথায় দাঁড়িয়ে দেশ

এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
৮ আগস্ট, ২০২৫ এ ৮:১৮ এএম
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সংগৃহীত

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত এই সরকার আজ এক বছর পূর্ণ করল। শুরুর সময় জনগণের মধ্যে ছিল অসীম প্রত্যাশা, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং একটি নতুন সূচনার স্বপ্ন। তবে এক বছর পরে দাঁড়িয়ে এই সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।

পর্যবেক্ষকদের মতে, জনগণের প্রত্যাশা এবং সরকারের বাস্তব অর্জনের মধ্যে রয়েছে বড় ফারাক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মব কালচার, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা হ্রাস পায়নি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি, এবং কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে বেকারত্ব বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ৮.৫৫ শতাংশে পৌঁছেছে এবং পাচার হওয়া অর্থ এখনো দেশে ফেরত আসেনি, যদিও কিছু বিদেশি সম্পদ জব্দ হয়েছে।

অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন—সবকিছুর মাঝেও সরকারের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। একটি বড় অর্জন হলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা ঘোষণা করা। সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে হয়েছে দৃশ্যমান অগ্রগতি। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা এনেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর একটি বিপর্যস্ত দেশকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়। সে অবস্থায় দেশকে সচল করা এই সরকারের অন্যতম সাফল্য।” তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা, রিজার্ভ ও আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, “যেসব রক্তপাত, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে এই সরকার এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু আমলাতন্ত্র ও পুলিশের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসায় সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।” তিনি উল্লেখ করেন, “পরিবর্তন চাইলে কাঠামোগত সংস্কার অত্যাবশ্যক।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিচার, নির্বাচন প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে অগ্রগতি সত্ত্বেও সুশাসনের ঘাটতি, দলীয়করণ, চাঁদাবাজি, মামলা-জামিন বাণিজ্য ও স্বচ্ছতার অভাব রাষ্ট্র সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য সফলতার তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সরকারের ১২টি সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন, যার মধ্যে রয়েছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, নির্বাচন ও আইনগত সংস্কার, সংবাদমাধ্যম ও ডিজিটাল অধিকার, শহীদদের সম্মান ও সহায়তা, এবং পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, টাকার মান বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় সফলতা সরকারের সক্ষমতা প্রমাণ করে। এছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে—যেখানে নারী, প্রবাসী ও নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রায় ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার তিনটি মূল স্তম্ভ—বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন—নিয়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৫০টি নতুন আইন প্রণয়ন, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর, পুরনো মামলার প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক সংলাপের ভিত্তিতে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার চারটি মামলার বিচার শুরু হয়েছে, যার একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারও অন্তর্ভুক্ত।

সরকার গঠন করেছে ১১টি সংস্কার কমিশন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে শিগগিরই 'জুলাই সনদ' স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।