তিন ইস্যুতে রাজনৈতিক মতানৈক্য, অনিশ্চয়তায় জাতীয় নির্বাচন ও ‘জুলাই সনদ’


ফাইল ছবি: আজকের প্রথা
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়—২০২৬ সালের রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। তবে এর আগে প্রয়োজন হবে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংস্কার এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি।
এই লক্ষ্য সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কিছু মৌলিক বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। আলোচনা মূলত তিনটি বিষয়ে আটকে আছে। এই অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধান না হলে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
সংলাপ কখনো গোপনে, কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে চলছে। যেটুকু প্রকাশ্যে এসেছে, তা থেকে স্পষ্ট—নির্বাচন কবে, কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখনও এক নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও স্বীকার করেছেন এই বাস্তবতা। সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের সপ্তম দিনে, রোববার তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হলেও সত্যি কথা হচ্ছে, আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি।’
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আইনসভার কাঠামোসহ নির্বাচনের সময়কাল ও পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি চায়—আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। তারা মনে করছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি। এতে বিএনপির একক আধিপত্যের আশঙ্কাও কমে যাবে এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাইয়ের সুযোগও সৃষ্টি হবে।
আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি নিয়েও মতভেদ রয়েছে। বিএনপি ও সমমনারা চাইছেন—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোটে এমপি নির্বাচিত হোন, আর উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হোক দলগুলোর নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের প্রস্তাব—উভয় কক্ষেই দলগুলোর মোট ভোট শতাংশ অনুযায়ী আসন বণ্টন হোক। এনসিপি একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে বলছে—নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোটে আর উচ্চকক্ষে ভোটের আনুপাতিক হারে সদস্য নির্বাচিত হোন।
এই পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে, জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন-এনসিপি জোট আইনসভায় তুলনামূলক বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ দেখছে।
গত শুক্রবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের ডাকা সমাবেশে জামায়াত, এনসিপিসহ সমমনারা জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরে। বিএনপি এতে ভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া দরকার। এতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা যাচাই করা যাবে। শুক্রবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে আদালতের মাধ্যমে জুলাই হত্যাকাণ্ডের কিছু অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বাধ্যবাধকতা সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে প্রায় সব দল একমত হয়েছে।
সরকার আশা করেছিল, জুনের মধ্যে মূল বিষয়গুলোতে ঐকমত্য তৈরি হলে জুলাইয়ের শুরুতেই ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করা যাবে। বিশেষ করে ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুবার্ষিকীতে সনদ সইয়ের পরিকল্পনা ছিল। তবে দলগুলোর অনড় অবস্থানের কারণে সেই সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানান, নির্ধারিত তারিখে সনদ সই সম্ভব না-ও হতে পারে।
লন্ডন থেকে ফিরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে জাতীয় নির্বাচন ও সীমিত পরিসরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপি চাইছে আলোচনার বিষয়বস্তু জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক।
সরকারি মহল মনে করছে, সংলাপের বাইরেও কিছু পক্ষ প্রক্রিয়াটির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা ঐকমত্য গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন কোনটি আগে হবে, সংসদে প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি কী হবে, আর ‘জুলাই সনদ’ আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না—এই তিনটি ইস্যু ঘিরেই মূল আলোচনা এখন আটকে আছে।
এর বাইরেও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সামনে এসেছে—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ পদে নিয়োগের জন্য সংবিধানে সার্চ কমিটি অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রস্তাব জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সমর্থন পেলেও বিএনপি বলছে, এটি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ।
বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “ঐকমত্য কীভাবে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে—তা আগে ঠিক করতে হবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো সনদে আসতে পারে, বাকি বিষয়গুলো এখন বাস্তবায়ন হবে না।”
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. তাহের জানান, আগে সার্চ কমিটি থাকলেও নিয়োগ হতো প্রধানমন্ত্রীর তালিকা থেকে। সংবিধানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলে ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “নানান দাবি তুলে কেউ কেউ নির্বাচন পেছাতে চাইছে। এতে দেশ ও জাতির সর্বনাশ হতে পারে।”
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেন, সরকার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ দেওয়ার কথা বললেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই আগামী ৩ আগস্ট এনসিপি নিজ উদ্যোগে সনদ পাঠ করবে।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের ১০ মে’র বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই ৩০ দিনের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
আজকের প্রথা/এআর