প্রেমের প্রতারণায় শিক্ষিকার আত্মহত্যা;

অভিযুক্ত শিক্ষক মাসুদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

আজকের প্রথা প্রতিবেদন
আজকের প্রথা প্রতিবেদন
৪ জুলাই, ২০২৫ এ ১:৩৪ এএম
নিহত লুৎফুন্নাহার লাকি আক্তার। ছবি : আজকের প্রথা

নিহত লুৎফুন্নাহার লাকি আক্তার। ছবি : আজকের প্রথা

টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিয়ের প্রলোভনে প্রতারিত হয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছেন লুৎফুন্নাহার লাকী (২৬) নামের এক স্কুলশিক্ষিকা। তিনি মধুপুর উপজেলার কুড়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং কেউটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে ২০২৩ সালে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বিটিপিটিতে প্রশিক্ষণের সময় সহকর্মী মো. ইবনে মাসুদের সঙ্গে লাকীর পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। প্রেমের সম্পর্কের একপর্যায়ে মাসুদ তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে লাকী বিয়ের চাপ দিলে মাসুদ জানান, তিনি ইতিমধ্যে বিবাহিত এবং তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। এরপর থেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন লাকী।

গত ২৪ জুন (সোমবার) রাত ১০টার দিকে নিজ বাড়িতে কীটনাশক পান করেন লাকী। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত তাকে মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরে অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

লাকীর মৃত্যুর পর তার ঘর থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পরিবার। ১১ পাতার ওই চিরকুটে লাকী তার মনের যন্ত্রণা, অপমান, এবং প্রতারণার কাহিনী লিখে গেছেন। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে ইবনে মাসুদকে উদ্দেশ্য করে লেখেন:

“তুমি জানতে তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমি কোনো দুর্ঘটনা নিশ্চিত ঘটাবো। তবুও আটকালে না। তুমি চাচ্ছো আমি মরে যাই, আর তুমি জগৎ সংসারে ভালো থাকো। আমি এখন পোকা মারার বিষ খাবো, আসার সময় কিনে এনেছি। আমার সঙ্গে যা করলে দুনিয়ার কোনো মানুষের সঙ্গে করো না প্লিজ। আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী।”

আরও উল্লেখ করেন:

“বিগত দুই বছর তুমি আমার মন পাওয়ার চেষ্টা করেছো। ফুঁসলিয়ে আমার সর্বনাশ করেছো। যখন আমি তোমার সকল কথা বিশ্বাস করলাম, তখন তুমি আমার হাত ছেড়ে দিলে। তুমি আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করলে। আমাকেই টার্গেট করে সমাজের কাছে অপরাধী করলে।”

সুইসাইড নোটের ভাষায় তার বিষণ্নতা ও ভেতরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ফুটে ওঠে। তার মতে, জীবনের যন্ত্রণা সইতে না পেরে মৃত্যুই ছিল শেষ উপায়।

লাকীর বাবা আব্দুল লতিফ বলেন, “আমি একজন কৃষক মানুষ। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে ইডেন কলেজ পর্যন্ত পড়িয়েছি। সে চাকরি পেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছিল। কিন্তু মাসুদের কারণে সে আজ পৃথিবীতে নেই। আমি ওই লম্পটের ফাঁসি চাই।”

মা কোহিনূর বেগম বলেন, “লাকী খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। সে কখনো প্রেমের বিষয় আমাদের বলেনি। হয়তো অনেক কষ্ট বুকের ভিতর জমা ছিল, যা আমরা বুঝতেই পারিনি। মাসুদের প্রতারণা ও মানসিক নির্যাতনে মেয়েটা মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে।”

কেউটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খাতুন বলেন, “লাকী ম্যাডাম অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। তিনি এত বড় সিদ্ধান্ত নেবেন, তা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি।”

অন্যদিকে, অভিযুক্ত শিক্ষক ইবনে মাসুদের কর্মস্থল গোপিনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খান জানান, “মাসুদ তিন দিনের ছুটিতে আছেন। তার স্ত্রীর মাধ্যমে ছুটির আবেদন পাঠানো হয়েছে। লাকীর ঘটনার পর থেকে তিনি বিদ্যালয়ে আসেননি।”

লাকীর মৃত্যুর পর ২৮ জুন তার বাবা আব্দুল লতিফ মধুপুর থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে শিক্ষক ইবনে মাসুদকে।

মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)  এমরানুল কবীর বলেন, “মাসুদ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে শিক্ষিকার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে শিক্ষিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন এবং বিয়ের দাবি করেন। কিন্তু মাসুদ বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা হয়েছে এবং তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”

লাকীর মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গত ২ জুলাই কেওটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও মধুপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতি, শিক্ষার্থীরা এবং স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা বুধবার (৩ জুলাই) মধুপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে মাসুদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে বহু মানুষ অভিযুক্ত মাসুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। অনেকে লিখেছেন, “একটি সম্ভাবনাময় জীবন এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না।” একজন প্রতিভাবান তরুণী শিক্ষিকার অকালে ঝরে যাওয়া যেন সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক জ্বলন্ত প্রমাণ। এই ঘটনা শুধু একটি আত্মহত্যা নয়, বরং আমাদের সমাজে নারীর নিরাপত্তা, সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলে দেয়। লাকীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, সেটাই প্রত্যাশা সবার।

 

আজকের প্রথা/এআরএএল