দেশব্যাপী অপরাধ বাড়ছেই

লাগামছাড়া অপরাধের ঢেউ; আতঙ্কে দেশজুড়ে শহর থেকে প্রান্তজনপদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
৩০ জুন, ২০২৫ এ ৫:১৬ এএম
ক্রাইম: প্রতিকি ছবি

ক্রাইম: প্রতিকি ছবি

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই এবং সংঘবদ্ধভাবে নির্যাতনের মতো অপরাধের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। যৌথ বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের ধারাবাহিক সাঁড়াশি অভিযানের পরও এসব অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। এমনকি শিশু-কন্যা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারীরাও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। চাঞ্চল্যকরভাবে লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স থামিয়ে ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে, যা জনমনে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটে, তা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে দেশে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে এবং প্রায় প্রতিটি আলোচিত অপরাধের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ভিডিও আন্তর্জাতিক পরিসরেও ছড়িয়ে পড়ছে, যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে মোট ১,১৩৯টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে ২২৮টি। আগের বছরে এই সংখ্যা ছিল মাসে গড়ে ১৫৮টি। একই সময়ে হত্যা মামলা হয়েছে ১,৫৮৭টি, যা গড়ে প্রতি মাসে ৩১৭টি; গত বছর এই গড় ছিল ২৮৬টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা পাঁচ মাসে দাঁড়িয়েছে ৯,১০০টিতে—মাসে গড়ে ১,৮২০টি, যেখানে আগের বছরের গড় ছিল ১,৪৬৪টি। অপহরণ, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে। অপহরণ মামলার গড় এখন ৮৭টি, আগে ছিল ৫৪টি; চুরি ও ছিনতাইয়ে পাঁচ মাসে গড়ে ৯৮৫টি মামলা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া পুলিশের দায়িত্ব পালনের সময় তাদের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে—মাসে গড়ে ৫৭টি, যেখানে আগের বছরে ছিল ৫৪টি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান আইন-শৃঙ্খলার অবনতির ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও আগের মতো পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে মাঠে কাজ করতে পারছে না। অধিকাংশ সময় কোনো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়; তার বাইরে মাঠ পর্যায়ে তারা সক্রিয়তার প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারী ধর্ষণের ঘটনা এবং তা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পর সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একইভাবে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা দেশের মানুষকে বিস্মিত করেছে। রাজশাহী থেকে মরদেহ নিয়ে ফেরার পথে পরিবারের সদস্যদের মারধর করে তাদের অলংকার, টাকা-পয়সা লুট করে ডাকাতরা; এমনকি মরদেহেও তল্লাশি চালানো হয়।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিকাদারি নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধের জেরে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে জামালপুরের ইসলামপুরে দুর্বৃত্তরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুর রহিমকে প্রশাসনের পরিচয়ে ডেকে এনে টেনেহিঁচড়ে উঠানে ফেলে কুপিয়ে হত্যা করে। মুখোশ পরে আসায় হত্যাকারীদের কেউ চিনে রাখতে পারেনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, বিগত মাসগুলোর তুলনায় বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন।

সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ জানান, গণ-অভ্যুত্থানের পর এখনো পুলিশের মনোবল পুরোপুরি ফিরে আসেনি। তবে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড বা ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। ভিডিও থাকলে তা পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত, যেন তদন্তের কাজে তা সহায়ক হয়।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে সব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। যেমন, লালমনিরহাটে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা, খুলনায় এক রাতে দুইটি খুন, গাইবান্ধায় ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর গণপিটুনিতে অভিযুক্ত যুবকের মৃত্যু, ঢাকায় তিনটি খুন, চট্টগ্রামে কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগ, এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে নারী নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনা।

এসব ঘটনায় স্পষ্ট হচ্ছে, দেশে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে এবং মানুষ এখন আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কার্যকর ভূমিকা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সহজ পথ নেই।

 

আজকের প্রথা/এআর