সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পে আবারও দুর্নীতির চিহ্ন


ছবি : আজকের প্রথা গ্রাফিক্স।
সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে বাস্তবায়িত ‘অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে। প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীদের বরাদ্দ অর্থ, কার্যক্রম, যাতায়াত ভাতা—সব কিছুতেই দুর্নীতির ছাপ পাওয়া গেছে।
ভোলার লালমোহনের যুবক মো. জুয়েল এই অনিয়মের সরাসরি ভুক্তভোগী। তিনি জানান, বন্ধুবান্ধব মিলে সমাজসেবা অধিদফতরের এক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি ছিল প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। কিন্তু কেউই কোনো টাকা পাননি। বরং তারা কার্যকর কোনো প্রশিক্ষণও পাননি।
তার ভাষায়,
“তিন দিন মাত্র এক ঘণ্টা করে ক্লাস হতো, সেটাও আড্ডার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে যেত। মনে হতো যেন একটা নাটক চলছে। আমাদের নিয়ে কেউ এমনভাবে খেলবে, সেটা ভাবিনি।”
তিনি আরও বলেন,
“প্রশিক্ষণের সময় বলা হয়েছিল, প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে পাবে। সেই আশায় উদ্যোগ নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো টাকা পাইনি। উল্টো সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বলে ১০০ টাকা করে নিয়েছে। অথচ আজও সেই সার্টিফিকেট চোখে দেখিনি।”
চরফ্যাশনের যুবক এহসান আলীর অভিজ্ঞতাও একইরকম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন,
“আমি ১০ হাজার তো দূরের কথা, বরং ১ হাজার টাকা দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। শেখার মতো কিছুই শেখানো হয়নি।”
জুয়েল ও এহসানের মতো অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে আরও অনেক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে। শুধু অনুসন্ধানে নয়, সরকারি মূল্যায়নেও এসব অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরীবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইইএমডি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরেই প্রকল্পটিতে ১৯৬টি অডিট আপত্তি রয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়মের ছাপ মিলেছে।
এই প্রকল্পটি প্রশিক্ষণার্থীদের জীবনে কার্যত কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া ‘অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয় লালমনিরহাট, জামালপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর ২৫টি উপজেলায়। এটি বাস্তবায়নে যুক্ত ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা—গ্লোবাল র্যাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (GRES)।
প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। খাতায়-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৫,১৮৫ জন তরুণ-তরুণীকে। তাদের অনেককে এতিম বা স্কুল-ড্রপআউট হিসেবে দেখানো হয়। প্রশিক্ষণের আওতায় রাখা হয় কম্পিউটার, ড্রাইভিং এবং গ্রাফিক ডিজাইন—যা বাস্তবে অনেকটাই লোকদেখানো ছিল।
অডিট বলছে দুর্নীতির পাহাড়
আইইএমডি’র তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী, ভুয়া সম্মানী, খাবার, যাতায়াত ভাতা এবং এমনকি জ্বালানির খরচ দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয় ৮০ লাখ টাকা। ভুয়া খাবারের খরচ দেখিয়ে তোলা হয় আরও ৭.৫ লাখ টাকা। আয়কর কর্তনে অনিয়ম করে ২১ লাখ টাকা, আর সর্বশেষে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কম্পিউটার ও আসবাবপত্র গায়েব করে দেওয়া হয়। জ্বালানির খরচ দেখিয়ে তোলা হয় আরও কিছু লাখ টাকা। এমনকি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া প্রশিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে আরও অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—সমাজসেবা অধিদফতরের ফাইলে এই প্রকল্পকে শতভাগ সফল বলে দেখানো হয়েছে। সেখানে ৯৯.৯৯ শতাংশ বাজেট খরচের হিসাব দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভয়াবহ।
প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এমন ২,৬৪০ জনের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ১২১ জন। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২,৫৪৫ জন, কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৭২ জন।
প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণেও অনিয়ম ধরা পড়ে। সেখানে বলা হয়েছিল, প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগে আয় হবে ৯ টাকা ৬২ পয়সা। বাস্তবে দেখা গেছে, আয় হয়েছে মাত্র ০.৩৬ পয়সা। সম্ভাব্য উপকারিতা ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা, কিন্তু অর্জিত হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকার মতো, যা স্থায়ী নয়।
সূত্র জানায়, তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নূরজ্জামান আহমেদের হস্তক্ষেপে তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় এই প্রকল্প চালু হয়। ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে পরিচালনার ফলে এর মান ও কার্যকারিতা দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল অযোগ্য, যারা প্রশিক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেনি।
এনজিওটি বাস্তবেই আছে?
‘গ্লোবাল র্যাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (GRES)’ নামক এনজিওটির অফিস নম্বরে ফোন করলে একজন গৃহবধূ কল রিসিভ করেন। তিনি বলেন, এই নামে কোনো এনজিওর নাম কখনো শোনেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইইএমডি’র এক কর্মকর্তা বলেন,
“প্রকল্পটি ছোট হলেও দুর্নীতির পরিমাণ ছোট নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।”
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই প্রকল্পের পরিচালক পন মার হালদার ও হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের মন্তব্যও নেওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,
“আমি খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব।”
বিশ্লেষকদের মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদ হক বলেন,
“প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের নামে যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মানহীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের নামে যারা লুটপাট করেছে, তারা বিচারের বাইরে থেকেই গেছে। কাগজে-কলমে সব ঠিক থাকলেও বাস্তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো।”
তার মতে,
“বিচারের ফাঁকফোকরই দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। ভবিষ্যতে মানসম্মত পরিকল্পনা, সুশাসন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এই ধরনের হরিলুট চলতেই থাকবে।”
আজকের প্রথা/এআরএম