নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা- সুস্থ আগামী প্রজন্মের ভিত্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৬ জুলাই, ২০২৫ এ ৩:৫৪ এএম
নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা : ছবি সংগৃহীত

নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা : ছবি সংগৃহীত

বাংলাদেশে নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা এখন সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। জন্মের পরপরই শিশুদের সঠিক যত্ন, পুষ্টি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমরা জানব কীভাবে বাংলাদেশে নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন হচ্ছে, কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে, এবং ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।

১. প্রসবের পর নবজাতকের প্রাথমিক সেবা
নবজাতক জন্মের পর প্রথম ২৮ দিন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময়ে শিশুর সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করাই মূল লক্ষ্য। অনেক হাসপাতালে বর্তমানে কেঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি চালু আছে যা অপরিণত শিশুর ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। সরকারি হাসপাতাল, মাতৃসদন ও কমিউনিটি ক্লিনিকে এসব সেবা এখন আরও সহজলভ্য হয়েছে।

২. গ্রামীণ এলাকায় শিশু স্বাস্থ্যসেবা
গ্রামীণ এলাকাগুলোতে শিশু স্বাস্থ্যসেবা অনেকাংশে কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি ক্লিনিকে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের প্রাথমিক সেবার জন্য প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। তারা শিশুর ওজন, উচ্চতা, টিকাদান এবং অন্যান্য প্রাথমিক সেবা দিয়ে থাকেন। তবে এখনও অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত ওষুধ, জনবল এবং যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে।

৩. টিকাদান কার্যক্রমের অগ্রগতি
নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে টিকাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সরকার EPI (Expanded Program on Immunization) এর মাধ্যমে দেশব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ডিপথেরিয়া, টেটানাস, হেপাটাইটিস বি, হামসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে টিকা শিশুর জীবন বাঁচাতে সহায়ক। UNICEF ও WHO এর সহায়তায় টিকাদান কর্মসূচি আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

৪. পুষ্টি ও শিশুর বিকাশ
শিশুর সঠিক পুষ্টি নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম ভিত্তি। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এরপর সুষম খাদ্য প্রদান ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে সচেতনতার অভাবে শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, যা ভবিষ্যতে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়।

৫. স্বাস্থ্যখাতে সরকারি উদ্যোগ
সরকার স্বাস্থ্যখাতে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতীয় শিশু স্বাস্থ্যনীতি, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক শক্তিশালীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে নবজাতক ও শিশুদের জন্য উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যকার্ড, অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও মায়ের মোবাইলে টিকা রিমাইন্ডার সুবিধাও চালু রয়েছে।

৬. বেসরকারি ও এনজিও ভূমিকা
বেসরকারি হাসপাতাল ও এনজিও গুলোও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্র্যাক, সীমান্তিক, সেভ দ্য চিলড্রেন, আরএফএল ফাউন্ডেশনসহ বহু সংস্থা দুর্গম এলাকায় মা ও শিশুদের চিকিৎসা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করে থাকে। এছাড়া কিছু এনজিও নিয়মিতভাবে শিশুদের ওজন, টিকাদান, অ্যানিমিয়া পরীক্ষা ইত্যাদি সেবা দিয়ে থাকে।

৭. সচেতনতার অভাব ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে এখনও অনেক মানুষ নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেক মা প্রসব পরবর্তী সময়ে শিশুর যত্নে প্রচলিত ভুল ধারনা অনুসরণ করেন, যেমন—শুধু পানি খাওয়ানো বা দুধ ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া। এছাড়াও, শহরের তুলনায় গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি কম, যা শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

৮. প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মোবাইল অ্যাপ, টেলিমেডিসিন, অনলাইন পরামর্শ সেবা ইত্যাদির মাধ্যমে এখন শহর-গ্রাম উভয় জায়গা থেকেই সেবা পাওয়া সম্ভব। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে নবজাতকের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, ডাটা অ্যানালাইসিস ও পূর্বাভাস নির্ভর চিকিৎসা চালু হতে পারে।

নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা মানেই একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম প্রজন্ম গড়ে তোলা। সরকারের নীতিমালা, বেসরকারি সংস্থার সহায়তা এবং সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা—এই তিনটি একত্রে কাজ করলে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার আরও কমানো সম্ভব হবে। প্রতিটি শিশুর জন্য নিশ্চিত হোক সুস্থ জীবন ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা।


আজকের প্রথা / মেহেদি হাসান