অঙ্গদান: জীবন বাঁচানোর নীরব সম্ভাবনা


ছবি : সংগৃহীত
অঙ্গদান হলো জীবিত বা সদ্য মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে অঙ্গ বা টিস্যু সরিয়ে অন্য একজন অসুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করার একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া। যিনি অঙ্গ দেন তিনি দাতা, আর যিনি অঙ্গ গ্রহণ করেন তিনি প্রাপক। যেকোনো বয়সের মানুষ এই প্রক্রিয়ায় দাতা হতে পারেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কয়েকটি ধরন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যালোজেনিক, যেখানে একই প্রজাতির দুজন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। অটোলোগাস প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির নিজের শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়। সিনজেনিক প্রতিস্থাপন ঘটে জিনগতভাবে অভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে, যেমন একজোড়া অভিন্ন যমজের ক্ষেত্রে। এছাড়া জেনোজেনিক প্রতিস্থাপন হয় দুটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে, যেমন মানুষ ও পশুর মধ্যে।
মানবদেহে বেশ কিছু অঙ্গ ও টিস্যু সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। যেমন—একটি কিডনি, লিভারের অর্ধেক, অগ্ন্যাশয়ের অংশ, ফুসফুসের অংশ ও অন্ত্র। সবচেয়ে বেশি প্রতিস্থাপিত অঙ্গের মধ্যে রয়েছে কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও অন্ত্র। টিস্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিস্থাপিত হয় কর্নিয়া, ত্বক, অস্থিমজ্জা এবং হার্টের ভালভ ও ধমনি।
বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর দাতার অভাবে প্রায় ৫০ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন, কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে মাত্র ৩০ হাজার রোগী ডায়ালাইসিস গ্রহণ করতে পারছেন। প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়, কিন্তু আত্মীয়দের মাধ্যমে কিডনি সংগ্রহ করে গড়ে মাত্র ১২০ জন রোগী এই সুযোগ পান।
সম্পূর্ণ কিডনি বিকল (ইএসআরডি) রোগীদের ব্যবস্থাপনার বর্তমান চিত্রও উদ্বেগজনক। প্রতি বছর দেশে ৪০,০০০ মানুষ নতুনভাবে কিডনি বিকলের শিকার হন। ২০১৮ সালে রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে ছিলেন ১০,৪২১ জন। এর মধ্যে ১০,০০০ জন হেমোডায়ালাইসিস, ২৩৪ জন সিএপিডি এবং মাত্র ১৮৭ জন কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা পেয়েছেন। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ক্যাডাভেরিক রেনাল ট্রান্সপ্লান্টেশন বা মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন হতে পারে বিকল্প ও কার্যকর সমাধান।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেখানে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন সফলভাবে চালু রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনও এই খাতে পিছিয়ে আছে। ভারতে বছরে প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়, যার মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ হয় মৃত দাতার অঙ্গ দিয়ে। কোরিয়ায় এ হার ৫ শতাংশ, আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ১৫ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ২৬.৫, ইংল্যান্ডে ২৫, অস্ট্রেলিয়ায় ২৩.১ এবং স্পেনে ৪৯.২ শতাংশ।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটি মৃতদাতার অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে, তবে দুটিই ব্যর্থ হয়েছিল। তাই এই খাতে অগ্রগতি প্রয়োজন। ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক সচেতনতা জরুরি। গণমাধ্যমে প্রচারণা, চিকিৎসা পাঠ্যক্রমে মস্তিষ্ক মৃত্যুর ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা, জনসচেতনতা তৈরিতে আলোচনা ও প্রদর্শনী আয়োজন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: ফেলোশিপ ইন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট (কোরিয়া), সহকারী অধ্যাপক, নেফ্রোলজি বিভাগ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।